বরুণ মুখোপাধ্যায়ঃ- ভারতবর্ষের জনপ্রিয় উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্যে হোলি অবশ্যই অন্যতম। হোলি যেমন রঙের উৎসব তেমনই মিলনেরও উৎসব। প্রদেশ অনুযায়ী এর নাম এবং উদযাপনের বৈচিত্র থাকলেও মূল ভাবটি অটুট থাকে সর্বত্রই।
দোলপূর্ণিমার তিথিতে অনুষ্ঠিত এই উৎসবের নাম স্থানভেদে বিভিন্ন। কোথাও একে বলে হোলি কোথাও আবার দোলযাত্রা। বসন্ত ঋতুতে হয় বলে এই উৎসবকে বসন্ত উৎসব বলা হয়। তেমনই ফাগুয়া, ধুলি, ধুলেটি ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দোল পূর্ণিমার আগের রাতে ন্যাড়া পোড়ানো হয়। মানুষের মনের পাশবিক প্রবৃত্তিকে দূর করার উদ্দেশ্যে বাঁশ, খড়, কাঠ প্রভৃতি দাহ্য বস্তু দিয়ে তৈরি ন্যাড়া পোড়ানো হয়। একে কোথাও আবার বলে ‘হোলিকা দহন’।
হোলি প্রধানত হিন্দু ধর্মের উৎসব হলেও বর্তমানে সব ধর্মের মানুষই শামিল হন এই আনন্দ উৎসবে। রং খেলায় মেতে ওঠেন আট থেকে আশি। কোথাও আবির কোথাও আবার রঙিন জল ভরা বেলুন, পিচকারি নিয়ে চলে রং খেলা। সঙ্গে চলে নানান গান ও নাচ। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আবির খেলতেও দেখা যায়।
উৎসব-অনুষ্ঠানের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার সম্পর্ক নতুন নয়, তাই অন্যান্য উৎসবের মতোই হোলিতেও মিষ্টিমুখের রীতি আছে প্রায় সর্বত্রই। শরীর ও মনকে চাঙ্গা রাখতে হরেক রকমের খাবারের প্রচলন আছে সারা দেশে। আছে ঠান্ডা পানীয় থেকে গরম ভাজাভুজি খাবারের রকমারি আয়োজন।
এগুলির মধ্যে জনপ্রিয় হল—ঠান্ডা দুধ ও বাদাম, মশলা সহযোগে তৈরি ‘ঠান্ডাই’। মিষ্টি তেঁতুলের চাটনি, দই, মশলার জিভে জল আনা খাবার ‘দই ভল্লা’ বা ‘দই বড়া’। চানা ডাল ও গুড় দিয়ে তৈরি ‘পুরাণ-পলি’। মিষ্টি স্বাদের খাবার— ‘মালপোয়া’, ‘রসমালাই’, ‘বাদাম ফিরনি’ তো থাকেই। বিখ্যাত ‘ভাঙ-পকোড়া’-র কথা না বললেই নয়। ‘গুজিয়া’, ‘তিল লাড্ডু’-র প্রচলন আছে উত্তর ভারত ও ওড়িষাতে। অর্থাৎ সারা দেশে হোলিকে কেন্দ্র করে চলে দেদার খাওয়া দাওয়া।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হোলির রঙেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন, সাধারণ আবিরের পাশাপাশি এসেছে আকর্ষণীয় নানান রঙের পরিবেশবান্ধব ভেষজ আবির। তরল রঙেও হরেক কিসিমের উপকরণ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। দোলের আগে থেকেই রাস্তার দুইপাশে পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন অনেক ব্যবসায়ী।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই মহা সারম্বরে পালিত হয় এই দোল উৎসব। একে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হয় ছোট-বড় নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
পাড়ার ক্লাব, স্কুলের মাঠ, মন্দির চত্বর বা রাস্তায় চলে রং খেলা ও উৎসব-অনুষ্ঠান। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তর প্রদেশের মথুরা-বৃন্দাবন, রাজস্থানের উদয়পুর, মণিপুর, পাঞ্জাব, বিহার প্রভৃতি জায়গায় বেশ ধুমধামের সঙ্গে হোলি উদযাপিত হয়। কানপুরে একটানা সাতদিন ধরে চলে এই উৎসব।
পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে এই অনুষ্ঠান বসন্ত উৎসব নামে পালিত হয়। দেশ-বিদেশ থেকে আসেন প্রচুর পর্যটক। মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরের দোলযাত্রাও দেখার মতো। এখানে নানান অনুষ্ঠানের পাশাপাশি চলে নাম সংকীর্তন। বিষ্ণুপুরের মদন মোহন মন্দিরে ঘটা করে পালিত হয় দোল উৎসব।
ভারতবর্ষ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী নেপালে মহা ধুমধামে পালিত হয় দোল উৎসব। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, ইউএসএ-র স্প্যানিশ ফর্ক, জার্মানির বার্লিন, মরিশাসের পোর্ট লুইস, লন্ডন প্রভৃতি স্থানে নিজস্ব রীতিতে চলে এই রঙের উৎসব। অজস্র মানুষের উন্মাদনায় নিয়ম করে প্রতি বছর পালিত হয় হোলি।
সমগ্র দেশেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রঙের উৎসব হোলিতে মেতে ওঠেন সকলে। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ এই ভারতবর্ষে বিবিধের মাঝে মহামিলনের কথাই প্রধান হয়ে ওঠে এই উৎসবে।