সুদীপ ঘোষঃ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট প্রাচীন রাজবাড়ী। আর সেই রাজবাড়ী গুলিতেই প্রতিবছর জাঁকজমক পূর্ণ ভাবে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। দুর্গা পুজো হলেও প্রায় প্রতিটি রাজবাড়ীতে আছে নিজস্ব আলাদা আলাদা পুজোর নিয়মরীতি। সেইরকমই নিজেদের রীতি মেনে ষষ্ঠীর আগেই পুজো শুরু হয়েছে পুরুলিয়ার প্রাচীন কাশিপুর ও মানবাজার রাজবাড়ীতে।
পুরুলিয়ার কাশিপুর রাজবাড়ীর দুর্গাপুজো প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন। এখানে অষ্টধাতুর চতুর্ভুজা রাজ রাজেশ্বরী হিসাবে পুজিত হন। প্রাচীন রাজা পরিবারের জৌলুস আর নেই। কিন্তু এখনও রীতি মেনে জিতা ষষ্ঠীর পরের দিন এখানে পুজো শুরু হয়। রাম চন্দ্রের ষোলো কল্প ক্ষত্রিয় রীতি মেনে টানা ১৬ দিন ধরে মায়ের আরাধনা চলে। প্রতিদিন ছাগ বলি হয়। কথিত আছে, কাশীপুরে রাজা কল্যাণ শেখর সিং দেওয় বাংলার সেন রাজা বল্লাল সেনের মেয়ে রাজকন্যা সাধনা কে বিয়ে করে ফেরার সময় নবরানী সাধনা সেন রাজবাড়ির কুলদেবীকে লুকিয়ে নিয়ে চলে আসেন। পরে তার ভাই লক্ষণ সেন জানতে পেরে কুলদেবীকে ফিরিয়ে আনতে আসেন। শুরু হয় কল্যাণ শেখর সিংয়ের সাথে লক্ষণ সেনের যুদ্ধ মাইথনের নিকট। যুদ্ধে হেরে লক্ষণ সেন বিদায় নেওয়ার আগেই রানী গুহায় কুলদেবী প্রতিষ্ঠা করেন। যা মাইথনের কল্যানেশ্বরী মন্দির। রাজা ও রানীর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে এই কল্যানেশ্বরী মন্দিরের দেবী কয়েকদিন রাজ রাজেশ্বরী রূপে কাশিপুর রাজ বাড়ীতে পুজো নিতে আসেন। একটা সময় এই পুজোর রাজ আয়োজন ছিল। কামানের তোপধ্বনি হত। এখন সব মলিন হলেও ভাটা পড়েনি। সারাবছর বন্ধ থাকলেও পুজোর কটা দিন সাধারণ মানুষের জন্য প্রবেশ অবাধ কাশিপুর রাজবাড়ীতে। প্রতিদিনই থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ভক্তদের জন্য প্রসাদ।
পুরুলিয়ার আর এক প্রাচীন পুজো হল মানবাজারের গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ির।২৫০ বছরের পুরনো এই পুজোর বিশেষ গুরুত্ব এখানে মা দুর্গা প্রতিমায় নয়, ঘট ও নব প্রত্রিকা হিসাবে পুজিত হন। পিতৃপক্ষের নবমী থেকে দেবীপক্ষের দশমী পর্যন্ত টানা ১৭ দিন ধরে পুজো চলে। একটা সময় এই পুজোর আয়োজন ছিল রাজকীয়। এই পুজোয় হত কামানের তোপধ্বনি, ১০৮টি প্রদীপ জ্বলতো, রাজবাড়ীতে বসত রাজকীয় অনুষ্ঠান ও বিজয়ার দিন রাজা পরিবারের পুরুষরা জঙ্গলে শিকারে যেতেন। এখন আর সেই রাজকীয় ব্যাপার নেই। কিন্তু নিয়মরীতি আজও অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। তোপধ্বনির বদলে বাজি পোড়ানো হয়, জঙ্গলে শিকারের বদলে কাছের মাঠে খড়ের শিকার করে শিকার অনুষ্ঠান করা হয়। পুজোর কয়েকটা দিন দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা ভীড় করেন মানবাজার রাজবাড়ীতে। প্রতিদিন ভক্তদের জন্য থাকে বিশেষ ভোগ প্রসাদের ব্যবস্থা। আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের কাছে এই পুজো খুবই আকর্ষণীয়।
পুরুলিয়ার এই দুই প্রাচীন রাজবাড়ির পুজোতে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে সাধারণ মানুষ। জাতি, ধর্ম ও বর্ণের বিভেদ ভুলে পুজোর কয়েকদিন মানুষের জীবন ভরে উঠে আনন্দের আলোয়। শুধু পুরুলিয়া নয়, এই দুই রাজবাড়ির প্রাচীন পুজো দেখতে বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও বর্ধমান জেলার মানুষ ছুটে আসেন। পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড রাজ্য থেকে বা বাংলা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরাও ছুটে আসেন লাল মাটি ও পলাশের দেশ জঙ্গলমহলের পুরুলিয়া জেলার প্রাচীন পুজো দেখতে।
দেশ বিদেশের বিভিন্ন খবরের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সবার আগে জানতে লাইক ও ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ও গুগল নিউজ