অঋনদম সরকারঃ সম্প্রতি গড়ফায় নিজের ফ্ল্যাটে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন অভিনেত্রী পল্লবী দে । প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান লিভ ইন সম্পর্কের টানাপোড়েনেই আত্মহত্যা করেছেন পল্লবী । একসঙ্গে থাকা, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট, ফিক্সড ডিপোজিটে নমিনি হিসেবে নাম – সম্পর্কের এতটা গভীরে গিয়েও হঠাৎ করে কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন অভিনেত্রী ?
আরও পড়ুন-
- ডিফেন্স সার্ভিসে পাশ করেছেন মোট ৬৬২২ জন, দেখুন সম্পূর্ণ তালিকা
- মামলার মধ্যেই স্কুল সার্ভিসে ৫২৬১ টি নতুন শূন্যপদ এর বিজ্ঞপ্তি জারি
- রামকৃষ্ণ মিশনে শিক্ষক নিয়োগ
- পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করল মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস কমিশন
- কবে কোন কোম্পানিতে কর্মী নিয়োগ, দেখে নিন একনজরে
এমনটা নয় যে এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মাঝেমধ্যেই লিভ ইন সম্পর্কে থাকাকালীন রহস্য মৃত্যুর খবর সামনে আসছে। তাহলে কি লিভ ইন সম্পর্কের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে ?
লিভ ইন সম্পর্ক জিনিসটাই বা কি ? লিভ ইন কারা করতে পারবে ? কেনই বা লিভ ইন করবে ? লিভ ইনের সুবিধাই বা কি, আর অসুবিধাই বা কি ? কি কি জিনিস গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হয় লিভ ইন সম্পর্ক শুরু করার আগে ? কি বলছে ভারতীয় আইন ? – সবকিছু থাকছে এই বিশেষ প্রতিবেদনে।
লিভ ইন সম্পর্ক জিনিসটাই বা কি
২০২২ সালে দাঁড়িয়ে লিভ ইনের মানে আমরা কমবেশি হয়তো সকলেই বুঝতে পারি । বন্ধুত্ব থেকে প্রেম , প্রেম থেকে বিবাহ, জীবনের এই বাঁধাধরা ছকে অনেকেই নিজেকে ফেলতে চান না , আবার বিয়ের মতো একটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির আগে অনেকেই একটু পরখ করে নিতে চান একে অপরকে ।আটপৌড়ে ভাষায় বলতে গেলে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকবো অথচ স্বামী- স্ত্রী হয়ে সংসার করব না । বর্তমান প্রজন্মের একটা বড় অংশ এই লিভ ইন নীতিতে বিশ্বাস রাখে ৷ তাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চেয়ে লিভ ইনকেই বেশি গুরুত্ব দেন ।
সমীক্ষা কি বলছে
২০১৮ সালে লিডিং নিউজ অ্যাপ ইনশর্টস লিভ ইন রিলেশনশিপের উপর একটি অনলাইন সমীক্ষা চালায় । বিবাহের আওতার বাইরে একসাথে বসবাস করা নিয়ে ভারতের যুব সম্প্রদায়ের ভাবনা চিন্তার অভিমুখ কোন দিকে ? এটাই ছিল এই সমীক্ষার প্রধান প্রশ্ন ।
১.৪ লক্ষ মানুষ এই সমীক্ষায় অংশ নেন এবং মোট সংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন যে , ভারতীয় সমাজ এখনও লিভ ইন সম্পর্ককে একটি ট্যাবু বলে মনে করে । যেখানে ৪৭ শতাংশ মানুষ তাদের সঙ্গীর সঙ্গে লিভ ইনের পরিবর্তে বিয়েকে ভালো বলে মনে করেন ।
সমীক্ষার আরেকটি পর্যায়ে ৮০ শতাংশের বেশি ভারতীয় লিভ ইন ধারনাকে সমর্থন করে এবং ২৬ শতাংশ অংশগ্রহনকারীর মধ্যে জীবনব্যাপী লিভ ইন সম্পর্ককে উদযাপন করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ।
অনেকেই হয়তো বলতে পারেন লিভ ইনের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের কম্প্যাটিবল লাইফ পার্টনার খুঁজে পেয়েছেন । নিঃসন্দেহে সেটা একটা পজিটিভ দিক এই সম্পর্কের , কিন্তু পাশাপাশি প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও কিন্তু কোনো অংশেই কম নয়।
আর তাই লিভ ইন সম্পর্কে যাওয়ার আগে ঠিক কোন কোন বিষয় বিবেচনা করা উচিত তা নিয়ে বার বার সতর্ক করছেন মনোবিদরা ।
লিভ ইন সম্পর্কে জড়ানোর আগে আসুন জেনে নেওয়া যাক লিভ ইনের খুুঁটি নাটি বিষয় গুলো ।
লিভ ইন এর পরিপ্রেক্ষিত
পরিবারের সাথে মনোমালিন্য বা গুরুত্বহীনতায় ভোগা অথবা একের পর এক সম্পর্কে অসফলতা আটকাতে শেষ চেষ্টা । এর মধ্যে একটি অজুহাতও কিন্তু লিভ ইনে যাওয়ার কারন হতে পারেনা ।
পড়াশুনোর জন্য বা পেশাগত কারনে বাইরে থাকছেন বলে আপনার একজন হেল্পিং হ্যান্ড প্রয়োজন যে আপনার পার্সোনাল কেয়ার নেবে এই ভাবনা থেকেও যদি লিভ ইনে জড়ান তাহলেও যে কতটা সফল হবেন তাও নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না ।
লিভ ইনে যাওয়ার আগে
এক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন হল কেন লিভ ইন করতে চাইছেন ? এই প্রশ্নটা আপনার পার্টনারকে জিজ্ঞেস করার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন । এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা আপনার ও আপনার পার্টনারের কাছে দু রকম হতে পারে কিন্তু দুজনেই দুজনের ভাবনা ও মত নিয়ে স্বচ্ছ থাকুন । স্রেফ নতুন কিছুর স্বাদ নিতে গিয়ে জীবন নিয়ে পরীক্ষা করবেন না । বরং এই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে স্পষ্ট বোঝাপড়া থাকলে তবেই এগোন ।
বাড়িতে পারিবারিক আবহে থাকার সময়ে পরিবারের দৌলতে বা নিজেদের সামর্থ্যে যে সব সুযোগ-সুবিধা পান, বিয়ের পর তার অনেক কিছুই মেলে না। অনেকেই বলবেন লিভ ইন তো আর বিয়ে নয়— তাই এই যুক্তিতে যদি সেই সম্পর্ক থেকেও একই সুযোগ সুবিধা পাবেন বলে ভেবে থাকেন, তা হলে সে ভাবনা আপনার মনের ভুল। দায়দায়িত্ব নিয়ে খুব সিরিয়াস না হলে লিভ ইন-এ যাওয়ার কথা ভাববেন না।
লিভ ইনে ব্যক্তিসত্তা
আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু অভ্যাস রয়েছে৷ বিয়ের পর যা আমাদের বর্জন করতে হয়৷ অথবা বিয়ের পর এমন কিছু অভ্যাস থাকে, যা আমাদের মেনে চলতে হয় বা আমরা মানতে বাধ্য হই৷
এক্ষেত্রে আপনি যদি ভেবে থাকেন যে, লিভ ইনের ক্ষেত্রে সেই নিয়মে কোনও বদল আসবে না , তবে আপনি ভুল ভাবছেন৷ লিভ ইনের ক্ষেত্রেও অনেক নিয়ম থাকে যা আমাদের মেনে চলতে হয়৷
এক সঙ্গে থাকতে শুরু করা মানে কিন্তু সব কিছু আগের মতো চলবে এমনটা একেবারেই নয়। আপনার পরিচিত মানুষটির নানা অপরিচিত দিকে চলে আসতে পারে আপনার সামনে , তীব্র ভালবাসার মধ্যেও ঘটতে পারে বিব্রতকর কোনো ঘটনা বা তৈরি হতে পারে অযাচিত কোনো পরিস্থিতি। ৩-৪ ঘন্টার দেখা হওয়া , সময় কাটানো আর ২৪ ঘণ্টা সেই মানুষটার সঙ্গে কাটানো দুটো সম্পূর্ন ভাবে আলাদা ।
লিভ ইন করছেন বলে সঙ্গীকে গুরুত্ব অবশ্যই দেবেন সেটা স্বাভাবিকও কিন্তু বাড়তি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আপনাকে যেন নিজের ব্যক্তিসত্ত্বার সাথে আপোস না করতে হয় ।
লিভ ইনে থাকার সময় আর্থিক বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার ৷ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কার কতটা দায়িত্ব থাকবে অথবা দৈনন্দিন কাজে কে, কোন দায়িত্ব পালন করবেন , তা আগে থেকে ঠিক করে নেওয়া প্রয়োজন ৷
এমনকি লিভ ইনে থাকাকালীন সন্তান হলে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুতরফেই আগে থেকে চিন্তা ভাবনা থাকা দরকার। প্রয়োজনে নিজস্ব ব্যক্তিসত্তার সাথে দায়িত্ব নেওয়ার পরিকল্পনা করেই সন্তান নেওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ যদি খুব স্বাধীনচেতা হন , বারবার সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কথা বলেন, তবে লিভ ইনে না জড়ানোই ভালো । সেক্ষেত্রে জটিলতা ও অশান্তি আরো বাড়বে বই কমবে না ।
লিভ-ইন সম্পর্কের আইনি বিষয়
বর্তমানে ভারতে এমন কোনো আইন নেই যা লিভ-ইন সম্পর্কের ধারণা নিয়ে কাজ করে। কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগ এই ধরনের সম্পর্ককে কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট স্বীকৃতি দিয়েছে।
স্বাধীনতার আগে, লিভ-ইন সম্পর্কের বিষয়ে আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছিল একটি মামলায় । যেখানে প্রিভি কাউন্সিল একটি বিস্তৃত নিয়ম জারি করে এবং জানানো হয় যে যদি একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা পুরুষ ও স্ত্রী হিসাবে একসাথে বসবাস করেছেন বলে প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে আইন অনুমান করবে যতক্ষণ না বিপরীতটি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে তারা বৈধ বিবাহের ফলে একসাথে বসবাস করছিলেন।
স্বাধীনতার পর সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় লিভ-ইন সম্পর্ককে বৈধ বিয়ে হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এছাড়াও, অন্যান্য বিভিন্ন রায়ে, সুপ্রিম কোর্ট রেকর্ড করে যে লিভ-ইন-রিলেশনশিপ বেআইনি নয়। তবে, এই অবস্থানটি বাধ্যতামূলক নয়, সাম্প্রতিক একটি মামলায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে লিভ-ইন-রিলেশনশিপ একটি ওয়াক ইন এবং ওয়াক আউট সম্পর্ক।
প্রিভেনশন অফ ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট, 2005 এর অধীনে দুই সম্মতিপ্রাপ্ত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে লিভ-ইন সম্পর্ককে অবৈধ বলে গণ্য করা হয় না এবং যদি সেই যুগল স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সমাজের কাছে নিজেদের উপস্থাপন করে এবং একটি উল্লেখযোগ্য সময়ের জন্য তারা একসাথে থাকে, তাহলে সম্পর্কটিকে “বিবাহের প্রকৃতিতে” একটি সম্পর্ক বলে মনে করা হয়। ফলস্বরূপ, মহিলা সঙ্গী তার অধিকারের অধীনে ভরণপোষণ দাবি করতে পারেন । এমনকি এই ধরনের সম্পর্কের থেকে জন্ম নেওয়া শিশুরা তাদের পিতামাতার স্ব-অর্জিত সম্পত্তিতে অংশ পাওয়ার অধিকারী এবং বৈধ বলে বিবেচিত হয় । যদিও তারা হিন্দু অবিভক্ত পারিবারিক সম্পত্তিতে সহজাত অংশের অধিকারী নয়।
লিভ ইন না লিভ আউট ?
লিভ-ইন সম্পর্ক দম্পতিকে একে অপরকে আরও ভালভাবে জানতে সক্ষম করতে পারে ঠিকই তবে এই ধরনের সম্পর্কের অসুবিধাও রয়েছে।এই ধরনের সম্পর্কে আবদ্ধ যুগলরা প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় একাধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি পারিবারিক সমস্যারও মুখোমুখি হন।
আপনারা দুজনে যদি সবদিক বিবেচনা করে লিভ ইনকেই নিজের জীবনের অঙ্গ হিসেবে বেছে নেন তাহলে লিভ ইন সম্পর্ক আপনার, আর তার দায়িত্বও আপনার।