সুদীপ ঘোষঃ সময় যত যাচ্ছে, তত পর্যটক টানছে বাংলার বার্ড ভ্যালি কুলিক ফরেস্ট। উত্তরবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের কুলীক পাখিরালয় (Kulik Forest) হল এশিয়ার বৃহত্তম পক্ষিনিবাস। সারাবছর হাজার হাজার দেশী ও পরিযায়ী পাখিদের কূজনে মুখরিত হয় এই অভয়ারণ্য। আর তার টানেই কুলিক ফরেস্টে ভীড় জমাচ্ছেন পর্যটকরা।
উত্তর দিনাজপুর জেলার সদর শহর রায়গঞ্জ থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে ৩৪নং জাতীয় সড়কের গায়ে ১.৩০ বর্গ কিমি জুড়ে U আকৃতির কুলিক বনভূমি। এই কুলিক ফরেস্ট এশিয়ার বৃহত্তম ওপেন বার্ড সংচুয়ারি। কদম, শিশু, জারুল, শিরীষ, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাস, আম, ঝাম, শাল, সেগুন,অর্জুন, লালী ও পেয়ারা গাছের বিরাট জঙ্গল এই কুলিক। আর তার মাঝেই বয়ে গেছে ছোট ও শান্ত নদী কুলিক ও তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরা উপশিরার মতো খাল। গ্রীষ্মের প্রখর তাপ কমলেই কুলিক পাখিরালয় জুড়ে দেখা যায় অসংখ্য পাখিদের ভীড়। পানকৌড়ি, বক, কাঠঠোকরা, মাছ রাঙা, কোয়েল, দোয়েল, বসন্তবাউরি, বৌকথা কও, টিয়া, ময়না, শালিক, কাকাতুয়া সহ নানান প্রজাতির দেশী পাখি। আর দেশী পাখি ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা, সাইবেরিয়া থেকে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে এই বনে প্রজননের জন্য। তাদের মধ্যে প্রধান আকর্ষণ বিরল প্রজাতির এশিয়ান ওপেন বিল স্টক বা শামুক খোলা পাখি ও নাইট হর্ন পাখি। সব মিলিয়ে মোট ১৬৮ প্রজাতির পাখি আছে এই কুলিকের জঙ্গলে। বনদপ্তরের হিসাবে প্রতিবছর প্রায় ৮০-৯০ হাজার পাখি আসছে এই কুলীকের বুকে এবং প্রতিবছর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পাখি ছাড়াও কুলিক ফরেস্টে দেখা যায় শেয়াল, খরগোশ, বাঘরোল, বনবিড়াল, মেছো বিড়াল ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। আর এই জঙ্গলের লম্বা লম্বা তাল গাছে ঝুলে থাকে অসংখ্য বাদুড়।
এই সুন্দর সবুজ বনভূমির মাঝেই অন্যতম আকর্ষণ শান্ত কুলিক নদী ও তার শাখা খাল। এই কুলিক নদীর মাছ, কাংড়া, শামুক, কীট ও জঙ্গলের গাছের ফল হল পাখিদের প্রধান খাদ্য। এই কুলিক নদীর পাড়ে বসে কিংবা নদীর বুকে নৌকা বিহার করে মনের মানুষের সাথে মুহূর্তে হারিয়ে যান পর্যটকরা। কুলিক নদীর উপর ছোট সেতু পর্যটকদের ফটোগ্রাফির অন্যতম আকর্ষণ। জঙ্গলের উচুঁ ওয়াচ টাওয়ার থেকে রঙে বেরঙের পাখিদের লেন্স বন্দী করতে করতে সময় কেটে যায় পর্যটকদের।
কুলিক ফরেস্ট ছাড়াও তুলাইপঞ্জী চালের শহর রায়গঞ্জের নিকটে আছে বাংলাদেশ বর্ডারের জিরো পয়েন্ট, আত্রেয়ী নদী, বাহিন রাজবাড়ি ও নগর নদী। কুলিক পর্যটনকে কেন্দ্র করেই রায়গঞ্জ শহরের বুকে রাজ্য পর্যটন দপ্তরের টুরিস্ট লজ ও অনেক বেসরকারি হোটেল- রিসর্ট গড়ে উঠেছে। দিন দিন পর্যটকদের চাপ বাড়ছে কুলিক অ্যাভিয়ারিতে। পুজোর মরশুমে পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট হয়েছিল কুলিক প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। সামনের শীতেও রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকরা কুলিক ফরেস্টে আসবেন বলে স্থানীয় পর্যটন শিল্পের মানুষের ধারণা। শুধু কলকাতা বা রাজ্যের অন্য জেলা নয়, বিহার থেকেও পর্যটকরা আসছেন পাখিদের সমারোহ দেখতে। মনের মানুষ, বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে উইকেন্ডে ছুটির সেরা ঠিকানা এই সবুজে মোড়া পাখির রাজ্য কুলিক। তাই একটু সময় বের করে শহরের কংক্রিটের জঞ্জাল ছেড়ে রধিকাপুর এক্সপ্রেস বা কুলিক এক্সপ্রেস ধরে কিংবা ৩৪নং জাতীয় সড়ক ধরে বাস বা নিজের গাড়িতে চলে আসুন রায়গঞ্জ। প্রত্যহ ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতা ভুলে শনি- রবিবার কাটিয়ে দিন সবুজ বনরাশির মাঝে অসংখ্য পাখিদের কলতান মিষ্টি কলতানে গান শুনতে শুনতে।